এবার ভূমিকম্পে কাঁপলো, ভূমিকম্পের দেশ হিসাবে পরিচিতি জাপান। সোমবার দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এর পরপরই জাপানের আবহাওয়া সংস্থা ওই অঞ্চলে সুনামি সতর্কতা জারি করেছে। আবহাওয়া সংস্থার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, এই ভূমিকম্পের ফলে জাপানের উত্তর-পূর্ব উপকূলে ৩ মিটার (প্রায় ১০ ফুট) পর্যন্ত উচ্চতার সুনামি আঘাত হানতে পারে।
ভূমিকম্পের চার মিনিট আগে ৫.৮ এবং নয় মিনিট পর ৬.২ মাত্রার দুটি বড় আফটারশক রেকর্ড করা হয়। নিইগাতা, তোয়ামা ও হিয়োগো প্রদেশেও সুনামির ঢেউ দেখা যায়। দক্ষিণ কোরিয়ার পশ্চিম উপকূলেও ছোট ঢেউ পৌঁছায়। প্রথমে ৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু ঢেউয়ের আশঙ্কা করা হলেও পরে তা কমে আসে। সর্বশেষ হিসাবে এই ভূমিকম্পে কমপক্ষে ২২২ জন নিহত এবং এখনো ২২ জন নিখোঁজ রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইশিকাওয়া প্রদেশ। এর মধ্যে সুজু শহরে ৯৯ জন এবং ওয়াজিমা শহরে ৮৮ জন মারা গেছেন।
জাপানের বিভিন্ন গণমাধ্যম জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে ৭.২ মাত্রার এই ভূমিকম্পটি হোক্কাইডো উপকূলের কাছে আঘাত হানে। এর কেন্দ্রস্থল ছিল উপকূলীয় শহর আওমোরির কাছাকাছি, সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় ৫০ কিলোমিটার (প্রায় ৩০ মাইল) নিচে। তবে, আমেরিকার জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) অনুসারে, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭.৬। ভূমিকম্পটি স্থানীয় সময় রাত ১১:১৫ মিনিটে আঘাত হানে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের ৫৩.১ কিলোমিটার নিচ উৎপত্তিস্থল হওয়ায়, জাপানের আবহাওয়া দপ্তর ওই অঞ্চলে তিন মিটার (প্রায় ১০ ফুট) পর্যন্ত উচ্চতার সুনামির সতর্কতা জারি করেছে। সুনামির সম্ভাব্য প্রভাব থেকে উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এএফপি জানিয়েছে, এই বড় ভূমিকম্পের পর জাপান ইতোমধ্যে ৪০ সেন্টিমিটার (১৬ ইঞ্চি) উচ্চতার একটি সুনামি রেকর্ড করেছে।
প্যাসিফিক সুনামি সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের ১,০০০ কিলোমিটারের মধ্যে জাপান ও রাশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে বিপজ্জনক সুনামি ঢেউ আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাথমিক সতর্কতা হিসেবে, ইস্ট জাপান রেলওয়ে ওই এলাকায় তাদের কিছু ট্রেন পরিষেবা স্থগিত করেছে। পাবলিক ব্রডকাস্টার এনএইচকে জানিয়েছে, এই অঞ্চলের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তা পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হওয়ায় জাপান সব সময় দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকে।
জাপান ভূতাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত সক্রিয় ‘রিং অফ ফায়ার’ আর্ক (ইউরেশিয়ান, ফিলিপাইন ও প্যাসিফিক টেকটোনিক প্লেট) বরাবর অবস্থিত, যেখানে আগ্নেয়গিরি ও মহাসাগরীয় খাতগুলোর মিলন ঘটেছে। এই কারণেই বিশ্বে ছয় মাত্রা বা তার বেশি মাত্রার যত ভূমিকম্প হয়, তার প্রায় ২০ শতাংশ জাপানে ঘটে থাকে। ভূতাত্ত্বিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশটিতে বছরে প্রায় দেড় হাজারের মতো ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
রিং অফ ফায়ার বা আগুনের বৃত্ত হলো প্রশান্ত মহাসাগরের চারপাশের একটি বিশাল অঞ্চল যেখানে পৃথিবীর বেশিরভাগ সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ও ভূমিকম্পের কেন্দ্র অবস্থিত, যা টেকটোনিক প্লেটগুলোর সংঘর্ষ ও সাবডাকশনের (প্লেট নিচের দিকে ঢুকে যাওয়া) কারণে ঘটে।
এটি প্রায় ৪০ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ঘোড়ার নাল আকৃতির বেল্ট, যা নিউজিল্যান্ড থেকে শুরু হয়ে এশিয়া ও আমেরিকার পশ্চিম উপকূল ধরে আলাস্কা এবং আবার দক্ষিণ আমেরিকা হয়ে নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত, যেখানে প্রায় ৯০ শতাংশ ভূমিকম্প ও ৭৫ শতাংশ আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ ঘটে।
এই অঞ্চলটি ভূতাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত সক্রিয়, যেখানে ঘন ঘন ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘটে, যা জাপান, ফিলিপাইন এবং আমেরিকার মতো দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় আকারের ভূমিকম্প ইতিহাসে ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। জাপানের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্পটি আঘাত হানে ২০১১ সালের ১১ মার্চ। মাত্রা ছিল ৯.১, যা বিশ্বব্যাপী চতুর্থ শক্তিশালী ভূমিকম্প হিসেবে নথিভুক্ত।
ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট বিশাল সুনামি জাপানের উত্তর-পূর্ব উপকূলকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। এটি ফুকুশিমা দাইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মারাত্মক দুর্ঘটনার জন্ম দেয়, যার ফলে পারমাণবিক বিপর্যয় ঘটে। এতে প্রায় ১৮,০০০ মানুষ নিহত বা নিখোঁজ হয় এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল।
এরপর রয়েছে মহা হানশিন ভূমিকম্প। ১৯৯৫ সালের ১৭ জানুয়ারি কোবে শহরের কাছে এই ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। এর মাত্রা ছিল ৬.৯ । এই ভূমিকম্পটি অত্যন্ত কম গভীরতার ছিলো এবং ঘনবসতিপূর্ণ কোবে শহরে আঘাত হানায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এতে ৬,৪০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয় এবং ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়।
চলতি বছরের জুলাইয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম জাপানের তোকারা দ্বীপপুঞ্জের উপকূলে ৫.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল, যদিও তখন সুনামি সতর্কতা জারি হয়নি। এছাড়া, জুলাই মাসে রাশিয়ার কামচাটকা অঞ্চলে ৮.৮ মাত্রার একটি বিশাল ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল, যা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জন্য সুনামির ঢেউ তৈরি করেছিল এবং এটি গত ১৪ বছরের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম ভূমিকম্প ছিল।







