এবার“দাম কমার যে একটা আওয়াজ শুনেছি তা ভুল”, কারওয়ানবাজারে এসে বলেন ক্রেতা জিকরুল হাসান।
সরকার পতনের পর ফেইসবুকে নিত্যপণ্যের ‘সেনাবাহিনীর নির্ধারিত দর’ বলে একটি তালিকা ছড়িয়ে পড়েছে। সেই তালিকায় বিশ্বাস করে বাজারে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরেছেন তেঁজকুনিপাড়ার বাসিন্দা অর্ণব ঘোষ।
অর্ণব জানান, এই তালিকার দামের সঙ্গে বাজারদরের কোনো মিল নেই। এ নিয়ে বাজারে ক্রেতা বিক্রেতাদের মধ্যে তর্কাতর্কিও হচ্ছে।
দাবি করা হয়েছে, আলুর দর ৪০ টাকা, পেঁয়াজ ৭০ টাকা, গরুর মাংস ৬৫০ টাকা, খাসির মাংস ৮৫০ টাকা ও ব্রয়লার মুরগির দর ঠিক করা হয়েছে ১৪০ টাকা কেজি।
শুক্রবার এক কেজি খাসির মাংস কিনতে তেঁজকুনিপাড়া বাজারে গিয়েছিলেন অর্ণব। কিন্তু গিয়ে দেখেন দাম ১১০০ টাকা, পরে আধা কেজি কিনেই ফিরতে হয়েছে।
তিনি বলেন, “ফেইসবুকে দাম কমার তথ্য কারা ছড়ায় বা কেন ছড়ায় সেটা বুঝলাম না। এখন বুঝলাম দাম কমার প্রচারণা গুজব।”
অমিত পাল ও অপরাজিতা পাল দম্পতি কারওয়ান বাজারে গিয়ে এভাবে ধোঁকা খেয়েছেন। পাইকারি দরেই পাঁচ কেজি আলু কিনতে হয়েছে ২৮০ টাকায়, যা কেজিতে পড়েছে ৫৬ টাকা।
অপরাজিতা বলেন, “অনেকের পোস্ট দেখছিলাম দাম কমেছে। আলুর দাম ৪০ এ নেমেছে। কিন্তু বাজার সেই আগের মতই আছে। মনে হচ্ছে ছাত্রদের আন্দোলন করে এবার বাজার নিয়ন্ত্রণ করা লাগবে। না হয় ব্যবসায়ীরা দাম কমাবে না।”
এই তরুণীর যে আশা করেছেন, সেই চেষ্টাও চলছে। সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এবার বাজারে বাজারে গিয়ে ছাত্রদের প্রতিনিধি দল পণ্যমূল্য যাচাই করছেন।
দরদাম নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে বাজারে তর্কাতর্কি হচ্ছে বিক্রেতাদের। ক্রেতারা ফেইসবুকে প্রচারিত মূল্যে কিনতে চাইছেন। কিন্তু বিক্রেতাদের দাবি, তারা পাইকারিতেই কিনেছেন এর চেয়েও অনেক বেশিতে।
তেঁজগাওয়ের তেজকুনিপাড়া এলাকায় মুদি দোকানি শরীফ মাহমুদ বলেন, “পণ্যের দাম কমেছে এসব কথাবার্তা ফেইসবুক নাকি উড়তেছে। কাস্টমাররা আইসা তর্ক করে। কয় আমিই নাকি দাম বেশি চাই। আসলে দাম তো কমেই নাই।”
ফেইসবুকে যেসব পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে, তার একটিতে বরিশালে সেনাবাহিনীর মোবাইল নম্বরও দেওয়া আছে।
সেই নম্বরে কল করা হলে নিজেকে ক্যাম্প কমান্ডার মেজর রাশেদ পরিচয় দিয়ে একজন বলেন, “বাজারের মূল্য তালিকা নিয়ে যে পোস্টার হয়েছে তা আমরাও শুনেছি। তবে দ্রব্যমূল্যের তালিকা এটা আমাদের দেওয়া না।”
অন্য এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমার নম্বর তো অনেকের কাছেই আছে। যারা এই কাজটা করেছে তারা আমার নম্বরটা এখানে দিয়ে দিয়েছে।”
রাজধানীসহ সারা দেশে কাঁচাবাজারগুলো চাঁদাবাজমুক্ত করতে ও ‘অতি মুনাফালোভীদের’ সতর্ক করতে শিক্ষার্থীরা বাজারগুলোতে অভিযানে যাচ্ছেন।
তারা বিক্রেতাদের কাউকে চাঁদা না দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। বলছেন, ‘যে দামে বিক্রি করা উচিত’ তার চেয়ে যেন বেশি দাম নিয়ে যেন বাজার অস্থিতিশীল না করেন।
কুমিল্লার পদুয়ারবাজার ও টমছম ব্রিজ এলাকায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রিয়াংকা আক্তার, আনোয়ারা আনিকা, উম্মে হাবিবা মৌ, উম্মে হাবিবা সীথি ও মো. মমিন মজুমদারসহ আরও অনেকে বাজারে যান। এ সময় অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও ছিলেন।
প্রিয়াংকা আক্তার বলেন, “আমরা সাধারণত পাঁচটি বিষয়ের নজরদারির জন্য কাজ করেছি মূল্যতালিকা, পরিচ্ছন্নতা, মেয়াদ, পণ্যের ঘাটতি এবং চাঁদাবাজি।”
তিনি বলেন, “কয়েকজন বিক্রেতা জানিয়েছেন, প্রতিদিন বিকাল বেলায় দোকান প্রায় ১০০ থেকে ২০০ টাকা চাঁদা উঠানো হয়। নয়ত দোকান ভেঙে দেবে বলে হুমকি দেওয়া হয়। আর এ ধরনের কার্যকলাপগুলো বিএনপির কয়েকজন নেতা করছে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। চাঁদাবাজদের কারণেই বাজারে পণ্যের দাম কমছে না।”
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামানও এদিন শান্তিনগর বাজারে যান। তিনি পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মূল্য ও সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন।
তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করার জন্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেউ চাঁদাবাজিসহ হিডেন চার্জ নিতে না পারে, সেই ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।”
গত ১৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া সংঘাত সহিংসতা ও কারফিউয়ের মধ্যে টানা দুই সপ্তাহের বেশি সারা দেশে পণ্য পরিবহনব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম অস্থির হয়ে উঠেছিল। দুই দিন ধরে সরবরাহ ব্যবস্থা সচল হওয়ায় কাঁচামালের দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে।
কারওয়ান বাজার ও তেজকুনিপাড়া বাজার ঘুরে দেখা যায়, সবজি, ডিম ও মুরগির দাম কমেছে। তবে আলু, গরুর মাংস ও চালের দাম আগের জায়গায় রয়েছে। পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা।
কারওয়ানবাজারে কাঁকরোল ও বেগুন ৬০ টাকা, টমেটো ১৩০ টাকা, বরবটি ও করলা ৭০ থেকে ৮০ টাকা, পটল, ঢ্যাঁড়স ও চিচিঙ্গা ৪০ টাকা, শসা ৮০ থেকে ১০০ টাকা, কাঁচা পেঁপে ৩০ টাকা কেজি এবং লাউ আকারভেদে একেকটি ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
সবজি বিক্রেতা “আল আমিন ইসলাম বলেন, আগের তুলনায় দাম খুব বেশি কমে নাই, অল্প কমছে। যদি চাঁদাবাজি না হয় তাহলে আস্তে আস্তে দাম কমব।”
পাইকারিতে এই পেঁয়াজে বিক্রি হচ্ছে ১২৪ টাকা দরে। আলু বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকা কেজি দরে। আর খুচরায় পাঁচ থেকে ছয় টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে।
এই বাজারে আদা-রসুনের দাম কমেছে কেজিতে ১০ টাকা। চায়না রসুন বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজি দরে ও দেশি রসুন ১৮০ টাকা, ভারতীয় আদা ২০০ টাকা কেজি দরে ও চায়না আদা ২৫০ টাকা কেজি দরে।
আদা-রসুন বিক্রেতা মো. পলাশ খান বলেন, “আন্দোলনের আগে দাম কম ছিল। পরে দেশ অস্থিতিশীল হওয়ায় দাম বেড়েছিল। এখন আবার দাম কমেছে।”
কারওয়ানবাজারে বাজারে লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকা প্রতি হালি ডিম, সাদা ৪৪ টাকা ও হাঁসের ডিম ৬৫ টাকা হালি।
গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা দরে, খাসির মাংস ১১০০ টাকায়।
রাজধানীর চালের পাইকারি আড়ত বাবুবাজারে এক মাস আগের তুলনায় সব ধরনের চাল কেজিতে ৩ থেকে ৫ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে।
সেখানে মিনিকেটের দর এই মুহূর্তে মানভেদে কেজিতে ৬৩ থেকে ৬৮ টাকা, বিআর-২৮ ৫২ থেকে ৫৬ টাকা কেজি, নাজিরশাইল ৬৪ থেকে ৭৬ টাকা, হাইব্রিড মোটা চাল ৫৪ থেকে ৪৭ টাকা, গুটি স্বর্ণা ৫০ থেকে ৫৩, গুটি ৫২ থেকে ৫৬ টাকা কেজি ও পাইজাম ৫৬ থেকে ৫৭ টাকা।
বাবুবাজারের অন্তু-সেন্টু রাইস এজেন্সির বিক্রেতা আব্দুল জলিল বলেন, “২০ দিন আগে হাইব্রিড মোটা চাল কিনছিলাম ২ হাজার টাকা বস্তা। এখন সেটা ২২০০ টাকা হয়ে গেছে। দাম বেড়ে গেছে সব ধরনের চালেই।”
বুধবার মরিচের কেজি ১২০ থেকে ১৪০ টাকায় নেমে এসেছিল। তবে দুই দিনের ব্যবধানেই তা ৮০ টাকা বেড়ে ২০০ থেকে ২২০ টাকা হয়ে গেছে।
কারওয়ান বাজারের মরিচ বিক্রেতা আনিস আহমেদ বলেন, “দাম খুব উঠানামা করছে।”
ক্রেতা জিকরুল হাসান বলেন, “দাম কমার যে একটা আওয়াজ শুনেছি তা ভুল। মরিচের দাম উল্টা দাম বেড়েছে।”
বিক্রেতারা বলছেন, দাম বাড়া কমায় ব্যবসার হেরফের হয় কমেই। কারণ, পাইকারিতে বেশিতে কিনলে তারা খুচরাতেও বাড়িয়ে বেচেন, সেখানে কাম কমলে তারাও কমে বেচেন।
তারা স্বস্তিতে আছেন এই কারণে যে, ক্রেতা ফিরেছে।
কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা আনিস মিয়া বলেন, “এতদিন মানুষ বাঁচব না মরব সেটা নিয়াই আতঙ্কে ছিল। বাজারে তেমন ক্রেতা আসে নাই। এবার একটা সমাধান হইছে, বাজারে ক্রেতা ভিড়তেছে। আন্দোলনের শুরু থেকেই বেচাকেনা নষ্ট হইয়া গেছিল। এহন সব ঠিকঠাক হইব।”
ক্রেতা আল মামুন বলেন, “আন্দোলনের সময় পাড়া-মহল্লার অলিগলি থেকে মানুষ কেনাকাটা করত। আমিও বেশি জরুরি না হইলে আসতাম না। কিন্তু আমি বাজারেও ঘুরতেছি স্বাচ্ছন্দ্যে।