যদিও যুবকদের আইডল ছিলেন মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা। বাংলাদেশে সেরা পাঁচজন সেলিব্রেটির তালিকাও করা হয় সেখানেও মাশরাফি থাকতেন শীর্ষে। দেশের সেরা অধিনায়কের তকমা পাওয়া মাশরাফি ২০১৮ সালে যখন তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের হয়ে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেন ঠিক তখন থেকেই জনপ্রিয়তা হারাতে থাকেন।
তবে তার সংসদীয় আসনের (নড়াইল-২) উন্নয়নে নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে হারিয়ে ফেলা জনপ্রিয়তা অনেকটাই ফিরিয়ে আনেন। সব ঠিকঠাকভাবেই চলছিল। গত সাড়ে পাঁচ বছরে দুবার নির্বাচিত সংসদ সদস্যও হয়েছেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তার চুপ থাকাটা মেনে নিতে পারেনি ছাত্র সমাজ। তাকে নিয়ে সমালোচনা এখনও থামেনি। সবার একটাই প্রশ্ন, মাশরাফি কেন চুপ ছিলেন?
চুপ থাকার কারণ খোলাসা না করলেও নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি। জানিয়েছেন ছাত্রদের পাশে না থাকতে পারার কষ্টটা বয়ে বেড়াবেন আজীবন, ‘এই কষ্ট হয়তো আজীবন বয়ে বেড়াব। দেশের ক্রান্তিকালে মানুষের পাশে থাকতে পারিনি, করতে পারিনি কিছু, এটি আমাকে পোড়াবে। এখন আসলে এসব কথার উত্তর বা ব্যাখ্যা দেওয়ার অর্থ নেই। যদি সরাসরি বলি, অবশ্যই আমি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি অনেক মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে।’
আন্দোলনের শুরু থেকেই মাশরাফি ছাত্রদের সঙ্গে বসার চেষ্টা চালিয়ে যান বলেও শোনা যায়। চেষ্টা থাকলেও কেন সফল হননি এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘জাতীয় দলে খেলেছি, নেতৃত্ব দিয়েছি। অধিনায়ক থাকাকালীন দল খারাপ করলে তার দায় আমিই নিতাম। কিন্তু রাজনীতির বিষয় পুরোটাই ভিন্ন। এখানে আমি অধিনায়ক নই। আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। যেন ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারি। কিন্তু সুযোগটা না পেলে তো কিছু করার থাকে না। তবুও সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, কিন্তু সুযোগটা আমি পাইনি। তারপরও কাউকে দোষ দেব না। দায় আমারই। বিশেষ করে মানুষের যে আবেগ-ভালোবাসার জায়গা থেকে যে দাবি ছিল ক্রিকেটার মাশরাফির প্রতি, সেটি পূরণ করতে না পারার দায় মাথা পেতেই নিচ্ছি। রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি কিছু করার চেষ্টা করেছি- পারিনি।’
দলের বাইরে গিয়েও মাশরাফি চাইলে কিছু করতে পারতেন, তবে সেটি করলে পদত্যাগকেই বেছে নিতে হতো। নড়াইলের মানুষের কথা ভেবেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেননি বলে জানান মাশরাফি।
ক্ষমতাসীন দলে থেকে মাশরাফি কিছু করতে পারেননি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা পোস্টও করেননি আন্দোলনের পক্ষে। তবে বিপরীত চিত্র ছিল পরিবারে। স্ত্রী সুমনা হক ও মেয়ে হুমায়রা মোর্ত্তজা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন বেশ সরব। মাশরাফি তাদের কখনো নিরুৎসাহিত করেননি, ‘আমি বরং ওকে (হুমায়রা) এটিও বলেছি, ‘তোমার স্কুল থেকে বা বন্ধুরা আন্দোলনে গেলে তুমিও সঙ্গে থেকো।’
আমার পদের জন্য বা চেয়ারের জন্য তাকে বাধা পেতে হবে, এটি কখনো চাইনি। তাদের কাছেও জবাবদিহিতা করতে হয়েছে, কেন কিছু লিখতে পারিনি। আশপাশের অনেকেই প্রশ্ন করেছিল, কেন কিছু করছি না। আমি আমার অবস্থান বলেছিলাম, কেউ একমত হয়েছে, কেউ হয়নি। তবে মেয়ের কাছে অন্তত এটুকু জায়গা আমার আছে যে, বাবা তাকে আটকায়নি।’
রাজনীতিতে নাম লেখানোর আগে করা গ্রামের বাড়িটাও পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সেদিন ঘটে যেতে পারত বৃদ্ধ মা-বাবার আগুনে পুড়ে মরার মতো ঘটনাও। মাশরাফির সান্তুনা এটুকুই, ‘দিনশেষে সান্ত্বনা যে, মা-বাবা অন্তত প্রাণে বেঁচে গেছেন। যা গেছে, সেসব নিয়ে বলে লাভ নেই।’
রাজনীতি মাশরাফির কেড়ে নিয়েছে কুড়ি বছরের জমানো ক্রিকেটের খ্যাতি আর জনপ্রিয়তাটাকে। ক্রিকেট যার ধ্যান-জ্ঞান, সামনের সময়গুলোতে কী করবেন, কী ভেবে রেখেছেন সেটি এখনও জানেন না। মাশরাফির এখন একটাই অপেক্ষা ক্রিকেট দিয়ে ফেরা। সেটি যদি ছোট কোনো প্ল্যাটফর্ম, সেখানেও নিজেকে বিলিয়ে দিতে চান, ‘যদি ছোট কোনো প্ল্যাটফর্মে সুযোগ আসে, সেই জায়গা থেকে চেষ্টা করতে পারি। ক্রিকেট আমার রক্তে মিশে আছে। কেউ কখনো সহায়তা চাইলে অবশ্যই পাশে থাকব। কিন্তু বোর্ডে থাকার বাস্তবতা এই মুহূর্তে আমার নেই। ডিজার্ভও করি না।’