এবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন। তার চিকিৎসায় দেশি-বিদেশি চিকিৎসক নিয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খালেদা জিয়ার পরিবার ও তার দল এতে সায় দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি মাল্টিপোল ডিজিজ সেন্টারে তার লিভার প্রতিস্থাপনসহ জটিল চিকিৎসাগুলো করানো হবে। মেডিকেল বোর্ডের একজন সদস্য গতকাল সময়ের আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, সব দিক বিবেচনা ও সবার সিদ্ধান্ত মোতাবেক উন্নত চিকিৎসায় যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন বিএনপি চেয়ারপারসন। সেখানে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি অ্যাডভান্স হেলথ কেয়ার সেন্টারে ভর্তি করানো হবে। তবে সে সেন্টার কোনটি তা এখনও ঠিক হয়নি। আজকালের মধ্যে মেডিকেল বোর্ডের বৈঠকে যা চূড়ান্ত হবে। সম্ভাব্য তালিকায় ইউরোপের একটি দেশের নামও ছিল। কিন্তু খালেদা জিয়ার মূল অসুখ লিভার সিরোসিস ছাড়াও বেশ কয়েকটি জটিলতা রয়েছে। এসব বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যারা বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে যাবেন তারা ভিসাসহ অন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। আশা করা যায় এই মাসের মধ্যেই তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশ ত্যাগ করতে পারবেন।
এই চিকিৎসক বলেন, আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য খালেদা জিয়ার লিভার প্রতিস্থাপন করা। তবে এর আগে তার পুরো শরীর চেকআপ করে অন্য জটিলতাগুলো কমিয়ে আনতে হবে। প্রথমেই লিভার প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। তাই শারীরিক অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসন এখন কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ম্যাডাম আগের চেয়ে ভালো আছেন। প্রতিদিন বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক নেতারা আসছেন। তিনি সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন। আর দেশের পরিস্থিতি যেহেতু ইতিবাচক; সঙ্গত কারণেই তিনি স্বস্তিবোধ করছেন। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে অনেক সময় কাটাচ্ছেন। এগুলো মানসিক শান্তি। তার ঘুম ও খাওয়া-দাওয়া স্বাভাবিক নিয়মে হচ্ছে। স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটারগুলো সঠিক মাত্রায় রয়েছে। তবে শারীরিক জটিলতা তো আছেই। বয়সের কারণে মাঝেমধ্যেই কিছু জটিলতা সামনে আসে।
‘শিগগিরই বিদেশে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া’ শুক্রবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন বক্তব্যের পর আলোচনায় আসে দলের চেয়ারপারসনের বিদেশযাত্রা। দীর্ঘদিন ধরেই খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ড, দল ও তার পরিবার বিদেশে চিকিৎসার দাবি জানিয়ে আসছে। আইনের যুক্তি দেখিয়ে বরাবরই সরকার তা নাকচ করে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগের পর খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সামনে আসে। সব রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেন।
এভারকেয়ার হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলছে। গত ২২ জুন গভীর রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ারের করোনারি কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করা হয়। পরদিন তার হৃদযন্ত্রে বসানো হয় পেসমেকার। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে তার লিভার সিরোসিস রোগের চিকিৎসা দিতে ঢাকায় আসেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত জনস হপকিন্স হাসপাতালের তিন চিকিৎসক।
চিকিৎসা শেষে চলতি বছরের ২ জুলাই এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’য় ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন। সবশেষ গত ৮ জুলাই হঠাৎ প্রেশার ও রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ভোরে হাসপাতালে ভর্তি হন। সেই থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্তির পর গত চার বছরে খালেদা জিয়াকে বিভিন্ন সময়ে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকতে হয়েছে। আর কারাবন্দির পর থেকে এ পর্যন্ত ছয় বছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং এভারকেয়ার হাসপাতাল মিলিয়ে খালেদা জিয়া দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে হাসপাতালে আছেন।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে। ওই বছরের অক্টোবরে হাইকোর্টে আপিল শুনানি শেষে সাজা বেড়ে হয় ১০ বছর। এরপর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় বিএনপি নেত্রীর। করোনাভাইরাস মহামারির শুরুতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তার পরিবারের আবেদনে সরকার নির্বাহী আদেশে দুই শর্তে তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়। শর্ত হলো-তাকে নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে এবং তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। গত তিন বছরে পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে কয়েক দফা অনুমতি চাইলেও ওই শর্তের যুক্তি দেখিয়ে শেখ হাসিনা সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরদিনই রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ করেন।
চিকিৎসকরা জানান, ৮০ বছর বয়সি খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস ও কিডনিসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, প্রায় দেড় মাস ধরে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ম্যাডাম। গত কয়েক দিন ধরে ওনার অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল বলা যায়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে তাকে থাকতে হয়। এখন সিসিইউর সুবিধাসমেত কেবিনে তার চিকিৎসা চলছে।
বিদেশে মাল্টিপোল সেন্টারে ওনাকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা তাকে বিদেশে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। শিগগিরই তিনি বিদেশে যাবেন।
অন্যদিকে জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। গত ৬ আগস্ট দুপুরে দ্রুতগতিতে তার পাসপোর্ট নবায়নের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরে চিকিৎসাধীন বিএনপি নেত্রীর পক্ষে তার প্রতিনিধির কাছে নবায়নকৃত মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) হস্তান্তর করা হয়।
২০২১ সালের জুনে খালেদা জিয়ার পাসপোর্ট নবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশ নেওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়। পাসপোর্ট অধিদফতর দ্রুত পাসপোর্ট নবায়ন করে ডেলিভারির জন্য রেডি করলেও শেষ পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে খালেদা জিয়ার হাতে পাসপোর্ট না দেওয়ার নির্দেশনা আসে। এমনকি পরে তার নবায়নকৃত পাসপোর্ট বাতিলও করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই বন্দি অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। পরে তার পাসপোর্ট নবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হলে মাত্র ২ ঘণ্টার মধ্যেই তা হস্তান্তরের জন্য প্রস্তুত করে পাসপোর্ট অধিদফতর। তবে বিএনপি থেকে এখনও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কিছু বলা হয়নি।