যদিও অর্থের অভাবে টানা তিন দিন ধরে না খেয়ে থাকতে হয়েছিল মিয়ানমারের গাড়ি চালক মং মংয়ের স্ত্রী ও মেয়েকে। ২০২২ সালের ওই ঘটনার সময় মান্দালয় শহরে এক পর্যায়ে একটি সাইবার ক্যাফেতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তিনি খোঁজ পান একটি চক্রের।
সামরিক জান্তার হাতে বেশ কিছুদিন আগে গ্রেপ্তার হন মং মং। নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাকে। সরকারবিরোধীদের জন্য খাদ্য বহন করে নেওয়ার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় সংসার টেকাতে ঋণ নিতে হয় তার স্ত্রীকে।
গাড়ি চালক মং মং যখন কারাগার থেক বের হয়ে এলেন, তখন দেখলেন তার চাকরি আর নেই। পরিবারও ঋণের ভারে বিপর্যস্ত। এ অবস্থায় বাধ্য হয়েই ফেসবুকে কিডনি বিক্রির চেষ্টা করেন তিনি।
মং মং বলেন, ‘সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করেছি, জীবন খুব কঠিন। টাকার জন্য ডাকাতি করা বা খুন করা ছাড়া আমার বাঁচার আর কোনো উপায় ছিল না। আমার স্ত্রীর অবস্থাও একই ছিল, সে আর এই পৃথিবীতে বাঁচতে চাইছিল না। কিন্তু শুধু আমাদের মেয়ের জন্যই আমরা বেঁচে থাকলাম।’
গত জুলাইয়ে মং মং ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারির জন্য ভারতে যান। এক ধনী চীনা-বর্মী ব্যবসায়ী ৩ হাজার ৭৯ ডলার দিয়ে তার একটি কিডনি কিনে নেন। তিনি কিডনি বিক্রি করে যে অর্থ পেয়েছিলেন, তা মিয়ানমারের একটি শহুরে পরিবারের বার্ষিক গড় আয়ের প্রায় প্রায় দ্বিগুণ।
মিয়ানমারের এই গাড়ি চালকের গল্পের কথা জানিয়ে সিএনএন শুক্রবার প্রতিবেদনে লিখেছে, শুধু মং মং নয়, এমন গল্প দেশটির আরও অনেকের। দরিদ্রদের কিডনি কিনে নিচ্ছে ধনীরা।
এক বছরব্যাপী সিএনএনের করা অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মিয়ানমারে দরিদ্ররা ফেসবুকের মাধ্যমে ধনী ব্যক্তিদের কাছে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করছে। এই কাজ তারা করছে এজেন্টদের সাহায্যে। ওই এজেন্টরা ভারতে যাতায়াত করেন। অঙ্গ বিক্রির পুরো প্রক্রিয়াটি চলে আইন লঙ্ঘন করে, কারণ উভয় দেশেই ব্যাপারটি অবৈধ।
সিএনএন অন্তত তিনটি বার্মিজ ভাষার ফেসবুক গ্রুপে অঙ্গ বিক্রির প্রস্তাবের পোস্ট খুঁজে পেয়েছে। বিক্রেতা, ক্রেতা এবং এজেন্টসহ অঙ্গ ব্যবসার সাথে জড়িত দুই ডজন লোকের সাথে কথাও বলেছে। এসব বিষয় বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশটির অনেক মানুষ হতাশায় এ পথ বেছে নিয়েছেন।
অঙ্গ বিক্রি নিয়ে পোস্টের ব্যাপারে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার কাছে বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, এ ধরনের একটি অনলাইন গ্রুপ মুছে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে বিস্তারিত আর কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে মেটা। তবে তারা বলছে, ফেসবুক তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কখনই এমন কাজের অনুমতি দেয় না।
গত ফেব্রুয়ারিতে ফেসবুকে কিডনি বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন এক ব্যক্তি। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি বলেন, শরীরের কোনো একটি অঙ্গ বিক্রির সিদ্ধান্ত যে কারো জন্যই খুব কঠিন। কেউই এটা করতে চায় না। আমাকে এটা করতে হচ্ছে, কারণ এ ছাড়া আমার আর কোনো পথ নেই।
মিয়ানমারের জাতীয় কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, একটি কিডনি নিয়ে সুস্থভাবে বাঁচা সম্ভব। কিন্তু কিডনি বিক্রির সময় যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, বিশেষ করে অস্ত্রোপচারের ব্যাপারটি; এর দীর্ঘমেয়াদী খারাপ প্রভাব পড়ে। বড় ঝুঁকির ব্যাপার হলো, বাকি কিডনিটি নষ্ট হয়ে গেলে আর কোনো পথ খোলা থাকে না।
ক্ষমতাসীন জান্তা প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, ১৯৯৫ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে মিয়ানমারে মাত্র ৩০৮টি সফল কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
২০২১ সালের আগস্টে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গ্রেপ্তার হন মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি। এর পর থেকেই সামরিক জান্তার বিপক্ষে মাঠে নামে মানুষ। সেই থেকে চলছে যুদ্ধ। দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বাস করে।