দিল্লির লাজপত নগরের ৫৬ রিং রোডের একটি বাড়ি, যা এখন একটি চারতারকা হোটেল, একসময় ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার আশ্রয়স্থল।
প্রায় ৫০ বছর আগে, শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর যখন শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তার প্রথম ঠিকানা ছিল এই ভবনটি। তখন এটি ছিল ভারত সরকারের একটি সেফ হাউজ, যেখানে শেখ হাসিনা এবং তার পরিবার কিছুদিন আশ্রিত ছিলেন।
শহরের দক্ষিণপ্রান্তে পাঞ্জাবি অধ্যুষিত ওই এলাকায় এই বাড়িটার আলাদা করে কোনও বিশেষত্ব চোখে পড়ার কোনও কারণ নেই! কিন্তু আসলে ক’জনই বা জানেন প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে শেখ হাসিনা যখন প্রথম ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার ঠিকানা ছিল রিং রোডের ওপরে এই ভবনটাই?
আসলে তখন ৫৬ রিং রোড ছিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একটি ‘সেফ হাউজ’ বা গোপন অতিথিশালা। শেখ মুজিব আততায়ীদের হাতে নিহত হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন তার কন্যাকে সপরিবার ভারতে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রথমে তার থাকার ব্যবস্থা করেছিল এই বাড়িটিতেই।
পরে একাধিকবার হাতবদল হয়ে ওই ভবনটি এখন শহরের একটি ছিমছাম চারতারা হোটেলে রূপ নিয়েছে। নাম ‘হোটেল ডিপ্লোম্যাট রেসিডেন্সি’।
মজার ব্যাপার হলো, লাজপত নগরের ওই এলাকাটি এখন দিল্লির আইভিএফ চিকিৎসার প্রধান হাবে পরিণত– যার সুবাদে বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে হাজার হাজার নিঃসন্তান দম্পতি ওখানে আসেন এবং দিনের পর দিন ওখানকার হোটেল ও গেস্ট হাউসগুলোতে থাকেন।
কিন্তু বাংলাদেশের এই মেডিক্যাল ট্যুরিস্টদের যারা ওই বিশেষ হোটেলটিতে ওঠেন, তাদের হযতো কারওরই জানা নেই তাদের দেশের সবচেয়ে বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী থাকা শেখ হাসিনাও তার জীবনের চরম সঙ্কটের মুহূর্তে ওই একই ভবনে আশ্রয় পেয়েছিলেন!
সূত্র বলছে— ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই গোপনীয়, এবং শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে সেই গোপনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনাকে দেওয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত সীমিত এবং ‘মিনিমাম’। তার চারপাশে সাদা পোশাকের নিরাপত্তাকর্মীরা থাকেন এবং কোনো অতিরিক্ত ঝাঁকজমক নেই। নিরাপত্তার মূল স্তম্ভ হচ্ছে গোপনীয়তা, কারণ যতটা সম্ভব তার অবস্থান গোপন রাখা যাবে, ততই তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে।
শেখ হাসিনার চলাচলও সীমিত করা হয়েছে। তাকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়ার ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব কম প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও তার কিছু ব্যক্তিগত যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে, তবে বড় ধরনের জনসম্মুখে তার উপস্থিতি পরিহার করা হচ্ছে। তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও সীমিত রাখা হয়েছে। ভারত সরকার তাকে কোনো প্রকাশ্য রাজনৈতিক বিবৃতি না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে।
লাজপত নগরের ওই ঠিকানায় অবশ্য শেখ হাসিনা বা তার পরিবারকে খুব বেশিদিন থাকতে হয়নি।
শহরের ব্যস্ততম রাস্তার ওপর একজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথিকে দীর্ঘ সময় রাখাটা নিরাপদ নয় বিধায় তাদের সরিয়ে নেওয়া হয় দিল্লির কেন্দ্রস্থলে অভিজাত পান্ডারা রোডের একটি সরকারি ফ্ল্যাটে, যার বাইরে ঝোলানো থাকত ভিন্ন নামের নেমপ্লেট। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর সেখানেই ছিলেন তারা।
লাজপত নগরের সেই ভবনে এসে ওঠার ঠিক ৪৯ বছর বাদে বাংলাদেশ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা যখন আরও একবার ভারতে এসে আশ্রয় নিলেন – তখনও কিন্তু শহরে তার প্রথম ঠিকানায় তিনি থিতু হননি।
আসলে আজ থেকে ঠিক একশো দিন আগে অগাস্টের ৫ তারিখে চরম নাটকীয় পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা যখন ভারতে পা রাখেন, দিল্লির বিশ্বাস ছিল তার এই আসাটা একেবারেই সাময়িক – ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশে যাওয়ার আগে এটা একটা সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতির বেশি কিছু নয়!
যে কোনও মুহূর্তে তৃতীয় কেনও দেশের উদ্দেশে তিনি রওনা হয়ে যাবেন, এই ধারণা থেকেই প্রথম দু-চারদিন তাকে (ও সঙ্গে বোন শেখ রেহানাকে) রাখা হয়েছিল দিল্লির উপকন্ঠে গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানঘাঁটির টার্মিনাল বিল্ডিং-এই, যেটির নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার দেশের বিমান বাহিনীর।
কিন্তু চট করে শেখ হাসিনার তৃতীয় কোনও দেশে পাড়ি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠার পর ভারত সরকার তাকে হিন্ডন থেকে সরিয়ে আনে দিল্লির কোনও গোপন ঠিকানায়। পরে তাকে হয়তো দিল্লির কাছাকাছি অন্য কোনও সুরক্ষিত ডেরাতে সরিয়েও নেওয়া হয়েছে – কিন্তু এ ব্যাপারে ভারত সরকার আজ পর্যন্ত কোনও তথ্যই প্রকাশ করেনি।
কিন্তু ‘লোকেশন’ যা-ই হোক, ভারতে তার পদার্পণের একশো দিনের মাথায় এসে এই প্রশ্নটা ওঠা খুব স্বাভাবিক যে এখন শেখ হাসিনাকে কীভাবে ও কী ধরনের নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে? আর সেটার পেছনে কারণটাই বা কী?
সূত্র: বিবিসি বাংলা