আমি যখনই পারি রাস্তাঘাটে বিড়াল, পশুপাখি, এমনকি ঘোড়ারও চিকিৎসা বা সেবার প্রয়োজন হলে চেষ্টা করি সেটা করার। বাজপাখি অনেক সময় হয়তো আহত হয়ে পড়ে থাকে; যতটুকু সম্ভব সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে সেগুলোকে রেস্কিউ সেন্টারে দেওয়ার চেষ্টা করি। যতটুকু পারি নিজে সেগুলোর খরচ বহন করার চেষ্টা করি। তাদের খাবার, তাদের চিকিৎসা খরচ বহন করি। এমন অনেকগুলো সেন্টারে এসবের জন্য আমি টাকা পাঠাই। এমন সংস্থা ঢাকা বা কলকাতায় দুই জায়গাতেই রয়েছে। কেননা পশুপাখির সেবা করার ইচ্ছে আমার প্রবল। কিন্তু নাগরিক জীবনে প্রাণীদের তো ফ্ল্যাটবাড়িতে রাখা সম্ভব হয় না। এখানে যেমন জায়গার অভাব তেমনই পারিপার্শ্বিক পরিবেশেরও একটা বিষয় রয়েছে। তাছাড়া আমাদের দেশে কুকুর নিয়ে তো নানা রকম সমস্যার বিষয় রয়েছে। তাই আমি অন্তত এসব প্রাণীকে যারা সেবা দেয় তাদের সঙ্গেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে এটাকে আমার করণীয় বলে মনে হয়।
কুকুর বা চারপেয়ে যেসব প্রাণী রয়েছে তাদের আমি নিয়মিত খাবার দিই। আমি একান্তই, নিজে সবসময় পারি না। যারা স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন তাদের মাধ্যমে খাবার দেওয়ার কাজটা করার চেষ্টা করি। আবার রাস্তাঘাটে বা আমাদের আশপাশে প্রাণীরা নানাভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এ সময় তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দরকার। দেখা যায়, দ্রুত তাদের চিকিৎসা না দিলে ওই প্রাণীকে বাঁচানো যাবে না। এমন তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা দেওয়ার কিছু কাজ শিখেছি।
দ্রুত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য টুকটাক বিড়াল বা কুকুরকে ইনজেকশন দিয়েছি। তবে এই ধরনের কাজ আমি যে একাই করি তা কিন্তু নয়। আমি আপনাদের পরিচিত বলেই হয়তো আমার কাজটা দেখতে পাচ্ছেন, এমনটা কিন্তু অনেকেই করেন। আবার এটাকে অনেকে মনে করেন আমি জয়া আহসান, মনে হয় অনেক বড় কাজ করছি; তা কিন্তু নয়। অনেকেই আছেন আমার চেয়ে অনেক বড় ভাবে, অনেক বিস্তৃতভাবে এসব কাজ করছেন। তারা নিভৃতে করে যাচ্ছেন, তাদের হয়তো কেউ চেনেন না। তারা কেন করছেন, ঠিক ওই বোধের জায়গা থেকে। এটা দেখানোর কোনো বিষয় নয়।
কভিডের সময় আমার কিছু কাজ গণমাধ্যমে প্রচার পেয়েছিল। আমি নিজেও সামাজিক মাধ্যমে ওই সময় প্রাণীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছি। সেই সময় সবাই কষ্ট পাচ্ছিল। হোটেল, রেস্তোরাঁ সমস্ত কিছু সে সময় বন্ধ ছিল। কুকুররা সাধারণত আবর্জনা থেকে খাবার সংগ্রহ করে। যে হোটেল বা রেস্তোরাঁর পাশ দিয়ে ড্রেন যায়, সেখানে যে পানিটা ফেলে দেওয়া হয় সেটা খেয়ে জীবনধারণ করে। তাই কুকুরদের জন্য কভিডের সময় অনেক বেশি কষ্টদায়ক হয়ে পড়েছিল। তারা তখন তো কিছুই করতে পারছিল না। সেজন্য সে সময় আমি সকালে বের হয়ে কুকুরদের খাবারগুলো দিতাম। প্রথমেই কারওয়ান বাজার গিয়ে, যা পেতাম নিয়ে এসে রান্না করে তারপর বেরিয়ে পড়তাম। সে সময় আমার কাজের চেয়েও অনেক বেশি মানুষকে এই কাজ করতে দেখেছি।
আমি খুব আলাদা কিছু করে ফেলেছি তা নয়। প্রাণীদের প্রতি সংবেদনশীলতা এটা খুবই স্বাভাবিক। এটাকে গ্লোরিফাই করতে চাই না। বিষয়টি আমার কাছে স্বাভাবিক। আমরা নিজেরাই সৃষ্টির সেরা জীব ঘোষণা করছি। অথচ আমাদের আশপাশে প্রাণ, প্রকৃতি রয়েছে এসবকে সৃষ্টিকর্তা পাঠিয়েছেন আমাদের জন্য, তাদের নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য। আমরা সেসব না করেই নিজেরা বারবার বলি, আমরা সৃষ্টির সেরা জীব। নিজেদের ইচ্ছেমতো যাকে ইচ্ছে রাখব, যাকে ইচ্ছে রাখব না যাকে ইচ্ছে বধ করব; যে গাছ ইচ্ছে রাখব, এ রকম করে তো চলতে পারে না। এটা উচিত নয়। তাই আমার মনে হয়, প্রাণীর সেবা করার বিষয়টাকে আলাদাভাবে বিবেচনা করার কিছু নেই। খেয়াল করে দেখবেন, এখনকার বাচ্চারা বা নতুন যে প্রজন্ম হচ্ছে তারা কিন্তু এইসব বিষয়ে অনেক সচেতন।
আপনারা জানেন, হাতি পালনে লাইসেন্স প্রদান ও বিদ্যমান লাইসেন্স নবায়ন বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে আমরা একটি রিট করেছি। সার্কাসে, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ও চাঁদা তোলার মতো কাজে হাতিকে ব্যবহার এবং এসব কাজের জন্য নির্যাতনের মাধ্যমে হাতিকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কারণ তুলে ধরে রিটটি করেছি।
মা হাতির কাছ থেকে শিশু হাতিকে কেড়ে নিয়ে কয়েকমাস ধরে অমানুষিক নির্যাতন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই প্রশিক্ষণটা কিন্তু মধ্যযুগীয় বর্বরতা। এখনকার যে বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশে এটা কিন্তু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। প্রথমত, শিশু হাতির ওপর যে নির্যাতন সেটা তো আছেই। দ্বিতীয়ত মহাবিপদাপন্ন প্রাণীকে দিয়ে খেলা দেখানো কিন্তু আইনত ভীষণ অপরাধ। এটা কিন্তু বন বিভাগের লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয়েও চাঁদাবাজির সুযোগ করে দেয়। হাতি নিয়ে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে অনেকগুলো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অসাধু ব্যবসায়ী যারা আছেন তাদের মাধ্যমেই এসব হচ্ছে। এই বর্বরতাকে আমরা বন্ধ করতে চেয়েছি বরাবরই। এজন্য বহুবার বন বিভাগকে অনুরোধ করেছি। শেষ পর্যন্ত আমরা কোনো উপায় না পেয়েই মহামান্য আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। আমি আশা করছি, এই আশ্চর্য প্রাণ প্রকৃতি হাতিকে রক্ষা করার জন্য মহামান্য আদালত যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দেবে।
সব শেষে বলতে চাই, পশু-পাখি এখন আমাদের সমাজের অংশ তো বটেই, জীবনেরও অংশ হয়ে উঠছে। এমন বাসাবাড়ি খুব কম নেই, যেখানে কুকুর-বিড়াল সেই পরিবারের সদস্য হিসেবে মর্যাদা পাচ্ছে।