নারীর ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণ নিশ্চিতে জাতীয় সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত মহিলা আসন রাখা হয়েছে। সরকারি দল ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের সংখ্যার অনুপাতে এ আসনগুলোতে সদস্য নির্বাচন করা হয়।
আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস সামনে রেখে সংসদ তথা রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে তারা বলেন, গত ১৫ বছরে সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন নারীরা এ সন্তুষ্টিও রয়েছে নারীদের মধ্যে। তবে প্রকৃতপক্ষে নারীর ক্ষমতায়ন কতটুকু ঘটেছে তা নিয়ে নারীদের মধ্যেই নানা ধরনের মত রয়েছে।
‘নারীর জন্য বিনিয়োগ বাড়াও’ এ সেøাগান নিয়ে আজ দেশেও দিবসটি পালিত হবে। তার আগের দিন নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে জানতে চাইলে বিভিন্ন পেশা ও সংগঠনে প্রতিনিধিত্ব করা নারী নেতারা সংসদে সংরক্ষিত আসনে নারী সদস্য নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো পুরস্কৃত করার নীতি অনুসরণ করছে। এর ফলে প্রকৃত ক্ষমতায়ন প্রশ্নবিদ্ধ। সংসদে সংরক্ষিত ৫০ আসনে নারীদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দক্ষতা-যোগ্যতা বিবেচনায় নেওয়ার চেয়ে পারিবারিক অবদান আমলে নিয়ে নির্বাচন করে দলগুলো। এ ব্যাপারটি ক্ষমতায়নকে বিঘিœত করে বলে দাবি করেন পেশাজীবী নারীরা। তবে নানা বিপত্তি থাকলেও নারীর ক্ষমতায়ন একেবারেই ঘটছে না সেটাও বলা ঠিক হবে না উল্লেখ করেন তারা। নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে দায়িত্ব অর্পণের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলদের নির্মোহ থাকতে হবে বলে তারা মনে করেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘পুরস্কৃত করা এ প্রক্রিয়াটা তো এ সংসদে নতুন নয়। বহুদিন আগে থেকেই এটা অনুসরণ করা হচ্ছে। দলের প্রতিনিধি হিসেবে নারী সংসদ সদস্য আসেন। তারা তো নারীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আসেন না। যদিও ওখানে বলা হয় যে সংরক্ষিত মহিলা আসনে দেওয়া হয়েছে। তো এ ধারণাটা করার কোনো দরকার নেই যে তারা দেশের সব নারীর প্রতিনিধিত্ব করতে এসেছেন। এখন তারা যেহেতু সংরক্ষিত নারী আসনে আছেন, সেজন্য তাদের কাছে ক্ষমতায়নের চেয়ে গুরুত্বের হলো দলের পারপাস সার্ভ (উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন) করা।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক ও নারীনেত্রী শিরীন আখতার বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর নির্মোহ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না বলে সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচিত হয়ে এলেও এতে প্রকৃত অর্থে নারীর ক্ষমতায়ন বোঝায় না।’ নির্দিষ্ট করে সংসদের কথা বলা হলে ব্যাপারটা এরকম বলেই উল্লেখ করেন তিনি।
তবে গত ১৫ বছরে সর্বক্ষেত্র বিবেচনায় নেওয়া হলে নারী অংশগ্রহণ বেড়েছে। সংরক্ষিত মহিলা আসনে সংসদ সদস্য বেছে নিতে ব্যক্তিগত দক্ষতা-যোগ্যতা বিবেচনায় নেওয়া হলে প্রকৃত ক্ষমতায়ন বলতে যা বোঝায়, সেটি হতে পারত।
এ প্রসঙ্গে জাসদ সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য শিরীন বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিবাচক দৃষ্টি না থাকার ফলে সরাসরি নির্বাচন করে সংসদে আসার পথ সুগম হচ্ছে না। এর ফলে বর্তমান সংসদে মাত্র ২০ জন নারী সরাসরি নির্বাচন করে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছেন।’ তবে স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে নারীর ক্ষমতায়ন বিকশিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
শিরীন আখতার বলেন, ‘নানা বিবেচনায় মহিলা আসনে সদস্য নির্বাচন হয় বলে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতে ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সরাসরি নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আইনসভায় ঢোকার সুযোগ রাজনৈতিক দলগুলোকে অবারিত করে দেওয়া উচিত। তাহলেই প্রকৃত অর্থে নারীর ক্ষমতায়নের দিকে যাবে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ।’
১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আটটি সংসদে সরাসরি নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্যের সংখ্যা সর্বনিম্ন ৪ থেকে সর্বোচ্চ ২২ জন পর্যন্ত হয়েছে। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদে ২০ জন নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদে ছিলেন ২২ জন। ’৯১ সালে সংসদে ছিলেন মাত্র ৪ জন।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কন্যা তানিয়া বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটা কথা বলেন, নিজের অধিকার নিজেকেই আদায় করে নিতে হয়। ক্ষমতায়ন বা অধিকার নিশ্চিত করতে নারীদেরও আরও এগিয়ে আসতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে শ্রমিক নেতা রওশন জাহান সাথী বলেন, ‘সংসদে মহিলা আসনে ৫০ জন আমাদের দেশে এই পদ্ধতিটা আগের মতোই রয়েছে। দেশের জনসংখ্যা এবং সবকিছু মিলিয়ে সংসদ সদস্যের সংখ্যাটা বাড়ানো উচিত। আর নারীদের জন্য যে সংরক্ষিত প্রক্রিয়াটা রয়েছে, আমি মনে করি এটা না করে তাদেরও সরাসরি নির্বাচনে আসা দরকার। তাহলেই ক্ষমতায়ন ঘটবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংসদ সদস্য (এমপি) এমপিই হন। তিনি নারী হোক বা পুরুষ, সরাসরি সংসদ সদস্য হিসেবে যখন কাজ করবেন তখন ক্ষমতায়ন ঘটবে। যদি তিনি কাজের একটা জায়গা পান তাহলে তার কাজটা তিনি দেখাতে পারবেন। সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপিদের দায়িত্ব যদি আংশিক হয় তাহলে তো নারীদের ক্ষমতায়ন হয় না। তার দায়িত্বটা স্বতঃস্ফূর্ত হতে হবে এবং সব ধরনের সহযোগিতা তাকে যেন করা হয়।’
সাথী বলেন, ‘সংরক্ষিত মহিলা আসনে আমি সদস্য ছিলাম। তখন আমিও একটু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। কারণ যারা পুরুষ সদস্য তারা তেমন সাহায্য করতে চান না। সংসদে সমঝোতার মাধ্যমে কাজ করা উচিত। সংরক্ষিত সদস্যদের সঙ্গে সমঝোতার সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত।’
সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচিত নারী সদস্যদের নিয়ে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘বিগত ১০ বছরে সংসদের কার্যক্রম দেখলে সেখানে দেখা যাবে, তাদের যে অঞ্চল দায়িত্ব দেওয়া হয়, সেটার উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়েই তাদের বেশিরভাগ চিন্তা থাকে। নারীর জন্য মূল্যবান যেসব বিষয় থাকে সেগুলো নিয়ে কথা বলতে দেখা যায় না তাদের, এটা অবাক লাগে। যেমন ধরেন নারী নির্যাতনের বিষয়। এ বিষয়টা নিয়ে সংসদে নারী সদস্যদের খুব একটা কথা বলতে শুনি না।’