এ বছরের ১৯ জানুয়ারি কলকাতা থেকে নির্মিত সিনেমা ‘হুব্বা’ বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়েছিল। এরসঙ্গে বাংলাদেশের আরও দুটি সিনেমা প্রদর্শিত হয়। সেসময় বাকি দুটি সিনেমার নির্মাতা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। অভিনয় শিল্পীরাও এর প্রতিবাদ করেছেন। এক পর্যায়ে রাগে, ক্ষোভে ও অভিমানে অভিনেতা সাইমন সাদিক শিল্পী সমিতি থেকে পদত্যাগেরও ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই অভিযোগে প্রশ্নে যে, যেখানে ঢাকাই সিনেমা মুক্তি দেওয়া হয়েছে তার পাশে কেন আবার ভারতীয় সিনেমা মুক্তি পাবে?
প্রতিবাদ অবশ্যই একদিক থেকে যুক্তসঙ্গত, ঢাকাই সিনেমার সঙ্গে কলকাতা বা ভারতীয় সিনেমা একই সপ্তাহে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারটা। তবে আবার অন্যদিক থেকে বলতে গেলে, যদি ঢাকাই নায়কদের জোর থাকত তাহলে, বিশ্বের যে কোনো দেশের সিনেমা একযোগে প্রদর্শিত হলেও তাদের সিনেমায় দর্শক হত। যেমন শাকিব খানের হয়। কিন্তু একেবারেই দর্শক হবে না, এমন তো হতে পারে না। তার মানে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি বর্তমানে তীব্রভাবে তারকা সংকটে ভুগছে। অর্থাৎ, নায়ক-নায়িকা প্রচুর থাকলেও তাদের কারোরই সেই তারকা ইমেজ গড়ে উঠতে পারেনি, যেমনটি শাকিব খানের ক্ষেত্রে হয়েছে।
যেমন, কিছুই আগেই নব্বই দশকের ডাক সাইটে অভিনেতা ওমর সানী বলেছেন, নব্বই দশকের পর কোনো সুপারস্টার নায়িকাই হয়নি ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে। শুধু নায়িকাই নয়, সেই অর্থে নায়কও হয়নি যাদের নামের জোরে বিদেশি বা ভারতীয় সিনেমার সঙ্গে লড়াই করেই তাদের সিনেমা ব্যবসা করতে পারে। অথচ এইসব নায়ক-নায়িকাদের অধিকাংশের ক্যারিয়ারই প্রায় এক দশক হয়ে গেছে। এক দশকেও একজনের ক্যারিয়ারকে ব্যাবসায়িক ক্যারিয়ার বলা যাব না তাতো হতে পারে না।
একটি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়িয়েই থাকে তারকা অভিনয় শিল্পীর ওপর। বিশ্বের যেকোনো ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রেই এটা খাটে। অনেকেই বলেন, আজকে ঢাকাই সিনেমার বাজার পড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ তারকা শিল্পীর অভাব। অথচ এই ইন্ডাস্ট্রিতে সেই ষাট দশক থেকে শুরু করে নব্বই পর্যন্ত ঝাঁকে ঝাঁকে সুপারস্টার, মেগাস্টার ছিলেন।
সেই উত্তম কুমার খ্যাত রহমান, দিলীপ কুমার খ্যাত নাদিম, আজিম, হাসান ইমাম, নায়করাজ রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন, ওয়াসিম, ফারুক, আলমগীর, মেগাস্টার খ্যাত উজ্জ্বল, জাভেদ, সোহেল রানা, বুলবুল আহমেদ, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন, মাহমুদ কলি, বাপ্পা রাজ, রুবেল, সুজাতা, সুলতানা জামান, শবনম, সুমিতা দেবী, সুচন্দা, রোজী আফসারী, নাসিমা খান, শাবানা, কবরী, ববিতা, জয়শ্রী, চম্পা, সুচরিতা, নূতন, রোজিনা, অঞ্জু ঘোষ, দিতি, অরুণা বিশ্বাস, দোয়েল, শাবনূর, শাবনাজ, মৌসুমী, পপি, শিমলা, নিপূণ, পূর্ণিমা, মান্না, সালমান শাহ, নাঈম, সোহেল চৌধুরী, রিয়াজ, ফেরদৌসসহ অনেকে মিলে যে তারার মেলা বসত সেই চিরচেনা রূপটি কবেই কালের অতল গর্ভে হারিয়ে গেছে!
নায়কদের বিপরীতে যারা খলনায়ক ছিলেন তারাও সময়ের সেরা ‘খল সুপারস্টার’ ছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন- গোলাম মুস্তাফা, খলিল, এটিএম শামসুজ্জামান, রাজিব, মিজু আহমেদ, আহমদ শরীফ, সাদেক বাচ্চু, হুমায়ুন ফরীদি প্রমুখ। এখন যেখানে খল অভিনেতাই নেই সেখানে একজন নায়ক কী করে সুপারস্টার হয়ে উঠবেন?
চিত্র নায়িকা রোজিনা বলেন, এখন দু’চার জন নায়ক থাকলেও তাদেরকে সাপোর্ট দিবে সেরকম একজন নায়িকাও খুঁজে পাই না। এখন কোন নায়িকাই নেই যাদের দিয়ে নায়করা জ্বলেন উঠবেন। সুপারস্টার হয়ে উঠবেন। অথচ আমাদের সময়ের নায়িকারা কেউই কারো চেয়ে কম যায় নাই। এখন সেরকম নায়িকা কোথায় পাবেন?
চিত্রনায়িকা রোজিনার এই পর্যবেক্ষণটিও গুরুত্বপূর্ণ। একসময়ে যারা সুপারস্টার ছিলেন তাদের জুটিগুলো দেখলেই সেই ধারণা স্পষ্ট পাওয়া যায়। যেমন: সুজাতা-আজিম, হাসান ইমাম-সুলতানা জামান, রহমান-শবনম, রাজ্জাক-কবরী, ফারুক-কবরী, আলমগীর-শাবানা, বুলবুল আহমেদ-জয়শ্রী, জাফর ইকবাল-ববিতা, ওয়াসিম-রোজিনা, ইলিয়াস কাঞ্চন-দিতি, বাপ্পা-অরুণা, সালমান শাহ-মৌসুমী, রুবেল-পপি, মান্না-নিপুণ, রিয়াজ-শাবনূর, ফেরদৌস-পূর্ণিমা প্রভৃতি। এদের প্রত্যেকেরই আবার একাধিক নায়ক-নায়িকার সঙ্গে জুটি হয়েছে। খ্যাতিও পেয়েছে সবগুলোই। নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে শবনম, শাবানা থেকে শুরু করে চিত্রনায়িকা নূতন পর্যন্ত জুটি হয়েছে। প্রতিটি জুটিই সফল হয়েছে। আলমগীর, ওয়াসিম, ফারুক, সোহেল রানা, ইলিয়াস কাঞ্চনেরও বিভিন্ন নায়িকার সঙ্গে জুটি হয়েছে।
বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রিতে নায়ক-নায়িকা নেই এমন নয়। কিন্তু কেউই তারকা ইমেজের মধ্যে পড়েন না। ফলে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রির খালি মাঠে একাই ছড়ি ঘোরাচ্ছেন শাকিব খান। তার ছবিই একচেটিয়া ব্যবসা করছে। অন্যগুলো যদি ব্যবসা করে সেটা গল্পের জোরেই, নায়ক-নায়িকার জন্য না। সেজন্য শাকিব খালি মাঠের তারকা বলে অনেকে তাকে ‘সুপারস্টার’ মানতেও নারাজ।
সুপারস্টারের জন্য প্রথম যে গুণটি থাকা দরকার সোসাইটিতে সেই ‘ব্যক্তিত্ব’ বা ‘পার্সোনালিটি’র ইমেজ বা ভাবমূর্তিটিই গড়ে ওঠেনি শাকিব খানের। যিনি ‘সুপারস্টার’ তিনি রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সমাজ, জনতামণ্ডলী, নারীমহল সর্বত্রই এমন ভাবমূর্তির অধিকারী হবেন- সবাই তাকে দেখা মাত্র সমীহ করবে। সবার চোখেই একটা সম্ভ্রমের দ্যুতি দেখা দিবে, যা শাকিব খানের ক্ষেত্রে একদমই দেখা যায় না।
অথচ নায়করাজ রাজ্জাক, ফারুক, ওয়াসিম, সোহেল রানা, আলমগীরদের যেমন ইমেজ ছিল শাকিব খানের সেটা দুর্লভ। এমনকি সালমান শাহও অল্প বয়সেই ‘সুপারস্টার’ হিসেবে যেভাবে নিজেকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছিলেন পরবর্তীতে দুর্লভ হয়ে উঠেছে। তবে তার সময়ের মান্না সুপারস্টার হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন।
শুধু পার্সোনালিটিতেই না, শাকিবের সিনেমার উদাহরণ দিয়েও চলচ্চিত্র নির্মাতা মালেক আফসারী তাকে সুপারস্টার মানতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘সুপারস্টার মানে সুপারস্টারই। তার কোনো পরাজয় নেই। সব সময়েই বিজয়ীর বেশে পর্দার রঙ্গমঞ্চ ছাড়ে। সুপারস্টারকে সবাই ডাইরেকশন দিতে পারেন না। কারণ, গল্পটি সুপারস্টারের মতো করেই হয়। সুপারস্টার জাতীয় পুরস্কারের কথাও ভাবতে পারেন না। নয়তো তাকে গল্পের কাটাছেঁড়া মানতে হবে। আসলে একজন সুপারস্টারের গল্প সব নির্মাতারা বুঝতেও পারেন না। সুপারস্টারের নায়িকা কখনো ধর্ষিতা হতে পারবে না। যেমন ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’- এটিতে নায়িকা বুবলী ধর্ষণের শিকার হয়। এখানেই সুপারস্টারের পরাজয়। ফলে ছবির এ নায়ক ‘সুপারস্টার’ হতে পারেন না।
বর্তমানে শাকিব খান ছাড়া আরও যারা নায়ক হিসেবে অভিনয় করছেন তাদের মধ্যে সাইমন সাদিক, জিয়াউল রোশান, নিরব, ইমন বাপ্পী চৌধুরী, আরিফিন শুভসহ আরো যারা আছেন তাদের কারো সিনেমাই কি ভারতীয় সিনেমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যবসা করতে পারবে? যেমন শাকিব খানের সিনেমা করতে পারে? ওই যে ‘হুব্বা’ সিনেমায় মোশাররফ করিম বাজিমাত করলেন সেও তো ভারতীয় সিনেমার প্রতিনিধি হয়েই। এ অবস্থায় যদি নতুন সুপারস্টারেরই জন্ম না হয় ভবিষ্যতে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি কীসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে?