টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়ে আইসিসির শিরোপাখরা কাটাল ভারত। দলটির বহুল আকাঙ্খিত এই শিরোপা জয়ের মূল কারিগর পেসার জাসপ্রিত বুমরাহ। ইকোনমি চারের ঘরে রেখে ১৫ উইকেট নিয়ে সিরিজসেরাও হয়েছেন তিনি। অনবদ্য এই পারফরম্যান্সের পেছনের যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। শৈশবেই বাবা মারা যাওয়ায় বেশ কষ্ট করেই বড় হতে হয়েছে বুমরাহকে। সেসব নিয়ে ও বুমরাহর সাফল্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দীর্ঘ আবেগঘন এক পোস্ট দিয়েছেন তার ধর্মমাতা, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী দীপাল ত্রিবেদী।
এক্সে দেওয়া সেই পোস্টে শুরুতেই দীপাল লেখেন, ‘আমার ক্রিকেটজ্ঞান শূন্য। আমি বিরাট কোহলিকে আনুশকার (শর্মা) স্বামী হিসেবে চিনি। তিনি দারুণ এবং যখন তিনি নাচার চেষ্টা করেন, সেটা আমার অনেক পছন্দ। কিন্তু এই (দীর্ঘ) পোস্টটি আমার নায়ককে নিয়ে।’
বুমরাহর জন্মের বর্ণনা দিয়ে দীপাল এরপর লেখেন, ‘১৯৯৩ সালের একদিন, তখন মাসে আমার বেতন ৮০০ রুপিরও কম ছিল, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু (জাসপ্রিতের মা দলজীত) এবং প্রতিবেশী আমাকে ছুটি নিতে বাধ্য করল। সে (সন্তান জন্মদানের) অপেক্ষা করছিল। আমিও তখন ২২-২৩ বছরের হবো এবং আমি আহমেদাবাদের পালদি এলাকায় সেই ডিসেম্বরে দিনের বেশিরভাগ সময়ই হাসপাতালে কাটিয়েছি। আমার বন্ধু দলজিতের স্বামী জসবীর কয়েক মিনিটের জন্য বাইরে চলে গেলেন, তখন নার্স আমাদের নাম ধরে চিৎকার করেন এবং পরে আমার কাঁপা হাতে একটি শিশু রাখলেন। এটি ছিল প্রথমবারের মতো কোনো নবজাতক শিশুকে স্পর্শ করা। আমার শুধু মনে আছে শিশুটি দুষ্ট ছিল। সে হাসতে চেষ্টা করছিল কিন্তু সে সত্যিই হাসতে পারেনি। নার্স বলল, সে ছেলে। সে লিকলিকে এবং দুর্বল ছিল। আমার বন্ধু খুব খুশি ছিল। আমি আগে থেকেই তার মেয়ে জুহিকার (জাসপ্রিতের বোন) ধর্মমাতা ছিলাম।’
এরপরই বুমরাহদের কষ্টের গল্প শোনান দীপাল, ‘এটি একটি বলিউড সিনেমা। সেবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী চিমনলাল প্যাটেল মারা গেছেন। পরের দুই মাসের মধ্যে আমি একজন রাজনৈতিক রিপোর্টার হয়েছি, বেতনও সামান্য বৃদ্ধি হয়েছে। কিছু আইসক্রিম কিনে ভাগ করে খেয়েছি। আমার কাছে কোনো ফোন, ফ্রিজ এমনকি বিছানাও ছিল না! আমরা একটি দেয়ালই ব্যবহার করেছি এবং তার বাড়ি ছিল আমার কাছে স্বর্গের মতো। দুঃখজনকভাবে আমার বন্ধুর স্বামী শিঘ্রই মারা গেলেন। জীবন বদলে গেল। আমরা আশাহীন হয়ে পড়েছিলাম। সেই পুরো মাস আমি বাচ্চাদের লালন-পালন করেছি, পড়িয়েছি। ছেলেটা পড়তে চাইতো না কখনোই এবং তার সস্তা প্লাস্টিকের বল দিয়ে খেলা শুরু করে দিত। তাদেরকে দেখাশোনার সময় আমি তাদের বিস্কুটও খেয়ে ফেলতাম ক্ষুধায়। আমরা ক্ষুধার্ত থাকতাম, জীবন নিয়ে আমরা লড়াই করেছি, কান্না করেছি, যুদ্ধ করেছি। জুহিকা, যার ধর্মমাতা ছিলাম, সে এখনো পর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর বাচ্চা এবং সে আমাকে আশা দিয়েছিল। তার হাসি ও শক্ত আলিঙ্গন দিয়ে। যেটা সে এখনো দেয়। কিন্তু ছেলেটার সংগ্রাম ছিল বেশি কঠিন। আমরা তাকে এক প্যাকেট দুধ পর্যন্ত ঠিকঠাক দিতে পারতাম না। তার মা দিনে অন্ততপক্ষে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করত।’
বুমরাহর ধর্মমাতা লেখেন, ‘আমার মনে আছে, একবার আমার বেতন বাড়ল এবং আমি কুর্তা কিনতে পশ্চিম দিকে সবচেয়ে অভিজাত দোকানে ঢুকলাম। জাসপ্রিত সেখানে ছিল, ৮ বছর বয়সী ছেলে তার মায়ের দোপাট্টার আড়ালে লুকিয়ে আছে। সে একটি শীতের পোশাক চেয়েছিল এবং তাকে দেওয়া সেটি আমার একমাত্র উপহার। আমি দিওয়ালি, ক্রিসমাস এবং আমার জন্মদিন নতুন কুর্তা ছাড়াই কাটিয়েছি। কিন্তু তার সেই পোশাক রাজদীপ রানাওয়াত বা মনীশ মালহোত্রার (ডিসাইন করা পোশাকের) চেয়েও বেশি তৃপ্তি দিয়েছিল। বোনের মতো না হয়ে সে ছিল লাজুক স্বভাবের ছেলে। সে এখন কিংবদন্তি। অর্জনের খাতায় আরও যোগ করতে গত রাতে সে আমাদের বিশ্বকাপ এনে দেওয়ার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রত্যেক ভারতীয়ই তাকে নিয়ে গর্বিত এবং তার কাছ থেকে শিখতে হবে। তার সেই বিনয় এখনো আছে। তার নাম জাসপ্রিত বুমরাহ।
বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখার আগ্রহ ছিল না বলে দীপাল লেখেন, ‘আমি তার মায়ের পীড়াপীড়িতে একটি ম্যাচ দেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু অর্ধেক দেখেই থেমে গিয়েছিলাম কারণ আমি ক্রিকেট বুঝি না। সম্ভবত আমি দেখব যখন (যদি) অঙ্গদ (বুমরাহর ছেলে) ফুটবল খেলে! আমি এই দীর্ঘ পোস্ট এই কারণেই লিখেছি যে কখনো হাল ছাড়া যাবে না। আমি খুব ভাগ্যবান যে জাসপ্রিতকে প্রথম আমি হাত দিয়ে ধরতে পেরেছি। সেই মুহূর্তটি প্রায়ই আমাকে জীবনের কঠিন মুহূর্ত মোকাবেলা করার আশা দেখায়। তার মা দলজিৎ অবশ্যই অসাধারণ এই বাচ্চাদের বড় করে তুলেছে। কয়েক মাস আগে জাসপ্রিতের সুন্দরী স্ত্রী সঞ্জনা তার মান, নম্রতা এবং কমনীয়তা বজায় রেখে আমাদের দুপুরের খাবার পরিবেশন করেছিল। দেখো, আমাদের সেই বাচ্চা জাসপ্রিতের এখন নিজেরই বাচ্চা অঙ্গদ আছে। অবশ্যই, অঙ্গদ জসপ্রিতের চেয়ে অনেক বেশি সুদর্শন!
একেবারে শেষে জাসপ্রিতের ধর্মমাতা লেখেন, ‘আমি খুব কমই ব্যক্তিগত পোস্ট লিখি। কারণ আমি চাই, জীবনে কেউ আশা না হারাক। জাসপ্রিতের কথাই ভাবুন, তার সংগ্রামের কথা। ঈশ্বর তাকে কীভাবে সাহায্য করেছেন। ঈশ্বর আমাদের সবাইকে সাহায্য করবেন, কিন্তু প্রথমে আমাদের নিজেদের সাহায্য করতে হবে। দয়া করে, আমার সঙ্গে যোগ দিয়ে আমাদের সেই বাচ্চা জাসপ্রিতকে বিশ্বকাপ জয়ের জন্য অভিনন্দন জানান। আহমেদাবাদের একটি অখ্যাত এলাকা এবং স্কুল থেকে সে আমাদের সবাইকে গর্বিত করেছে। আমি তার মা দলজিৎ ও বোন জুহিকাকে ধন্যবাদ জানাই তাকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। তার স্ত্রী সঞ্জনা তার আত্মা। দুঃখিত জাসপ্রিত, আমি ম্যাচ দেখিনি কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি।’